সভ্যতার ভিত্তি কৃষ্টি, আর কৃষির ভিত্তি বীজ। সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে যেমন কৃষির উন্নয়ন হচ্ছে, তেমনি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জমির উৎপাদনশীলতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষির ও আমূল পরিবর্তন হয়েছে এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও সকল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আজ আমরা দানাজাতীয় খাদ্য শস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। তদপুরি ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও জলবায়ূ পরিবর্তন জনিত কারনে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলা করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করনে ভাল বীজের সরবরাহ নিশ্চিতকরণের কোন বিকল্প নেই।
খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অজর্নে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। আর ফলন বৃদ্ধির জন্য ভাল বীজের গুরুত্ব অপরিসীম। বীজ ভাল না হলে অন্যান্য কৃষি প্রযুক্তি যতই ব্যবহার করা হোক না কেন তা ভাল ফলন বয়ে আনবে না। ভাল বীজ নিশ্চিত করা গেলে ১৫-২০% ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের কৃষকদের মাঝে ভাল বীজ এর গুরুত্ব ও ভাল বীজ উৎপাদন সংক্রান্ত জ্ঞান অত্যন্ত অপ্রতুল। ফলে তারা বেশির ভাগ সময়ে সরকারি বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উৎপাদিত বীজের ভরসায় থাকে। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারী ভাবে যে পরিমান বীজ উৎপন্ন হয়, তা দিয়ে সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক থেকে মাঝারি কৃষকদের সচেতনতার অভাব ও অর্থের তরল্য সংকটের কারনে মৌসুমের শুরুতে বিএডিসি এর বীজ সংগ্রহ করতে পারে না। তাই চাষীদের মাঝে উন্নতমানের বীজ ব্যবহারের সচেতনতার বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ কৃষক নিজেদের উৎপাদিত বীজের উপর নির্ভরশীল এবং উন্নতমানের বীজের মাধ্যমে কৃষক উৎপাদিত বীজ প্রতিস্থাপনের হার মাত্র শতকরা ২০ ভাগ। উপরন্তু নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগে ফলন ক্ষতিগ্রস্থ হলে, বীজ ধানের সরবরাহ সংকটের মুখে পড়ে। যেমন গত ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের বোরো মৌসুমে হাওড় অঞ্চলে অকাল বন্যা ও উত্তরাঞ্চলে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণের কারনে কৃষক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তীতে পাহাড়ী ঢলের কারনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আউশের জমি প্লাবিত হয়। ফলে চলমান আমন মৌসুমে ইতিমধ্যে বীজ ধানের সংকট দেখা দিয়ে দিয়েছে। আগামী বোরো মৌসুমে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। ইতিমধ্যে বীজ সরবরাহকৃত প্রতিষ্ঠান বিএডিসি আগামী বোরো মৌসুমে বীজ ধানের প্রয়োজনীয় চাহিদা সরবরাহ করার অসামর্থের কথা জানিয়ে দিয়েছে। তাই ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবেলায় কৃষকদের আউশ ধানবীজ খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার পাশাপাশি উন্নত উপায়ে সংরক্ষণের মাধ্যমে বীজ ধান হিসেবে ব্যবহারের পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। বীজ ধান উচ্চমান সম্পন্ন না হলেও, কৃষকরা যেন আগামী মৌসুমগুলোতে অন্তত পক্ষে বীজ সংকটে না পড়ে সে ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে।
ফসল উৎপাদন ও বীজ ধান উৎপাদন এক কথা নয়। ফসল উৎপাদনের বেলায় ফলন মূখ্য হলে বীজ উৎপাদনের বেলায় ফলনের সাথে সাথে উৎপাদিত বীজের গুনগতমান নিশ্চিত করতে হয়। তাই বীজ ধান উৎপাদনের বেলায়, বিশেষ কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার, বীজ এর বংশগতি বিষয়ক প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও সর্বোপরি যতেœর প্রয়োজন। তাছাড়া কৃষক পর্যায়ে বীজ সংরক্ষণ এর ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে, কারন পরবর্তী ফসল উৎপাদনের জন্য পূর্ণ জীবনীশক্তি নিয়ে বীজের গুনগতমান নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকদেরকে বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের উপর প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা জরুরি। কৃষকদের সচেতন করা হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে বীজ শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব।
গ্রামের কৃষকদের নিয়ে দল সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের মধ্যে একতা ও সমবায় সৃষ্টির প্রচেষ্টা চলছে। আমাদের দেশে প্রান্তিক ও মাঝারি কৃষক বেশি হওয়ায়, কৃষি বিষয়ক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বৃহৎ বাজার সৃষ্টিতে দলগত পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরী। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো গেলে বাজার সংযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষকরা লাভবান হতে পারবেন। গ্রামের যুব সম্প্রদায়কে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে টেকসই উৎপাদন ও বীজ ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তুলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। তাছাড়া মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও বীজ সংরক্ষণ কার্যক্রমে নারী শ্রমিকের সম্পৃক্ত করনের মাধ্যমে নারী শ্রমের উপযোগীতার ব্যবহার সম্ভব। এর ফলে যেমন নারী ক্ষমতায়ন বেগবান হবে অন্যদিকে পল্লী অঞ্চলের দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া বীজ ধান উৎপাদনে পারদর্শী কৃষকরা ধান চাষের সচেতনতা কাজে লাগিয়ে ফলন বৃদ্ধি করতে সম্ভ হবে। কৃষকরা উত্তরোত্তর আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী হবে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ব্যাপারে কৃষকদের সচেতন করে কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। কৃষক পর্যায়ে বীজ উৎপাদনের মাধ্যমে বীজ চাহিদা যেমন মেটানো যাবে, তেমনি দেশের কৃষির সার্বিক উন্নয়ন তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে।
উত্তর সমূহ